মসজিদটির নাম শুনে মনে হতে পারে মসজিদটি চীনাদের তৈরি কিংবা এর নির্মাণের পেছনে চীনাদের কোনো অবদান আছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। মূলত পুরো মসজিদে রঙিন উজ্জ্বল চীনা মাটির পাথরের টুকরো দ্বারা চিনির দানার মতো নিখুঁত কাজ করা হয়েছে। এ কারণে মুসলিম স্থাপত্যের এই মসজিদটি ‘চিনি মসজিদ’ নামে পরিচিত।
জানা গেছে, ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে যে কয়টি মসজিদ রয়েছে চিনি মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য হিসেবে চিনি মসজিদের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর শহরের পাশে এটি অবস্থিত। প্রতি শুক্রবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে আসেন জুমার নামাজ আদায় করতে।
ঐতিহাসিক এই মসজিদ নির্মাণের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। ১৮৮৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামে দুই ব্যক্তি সৈয়দপুরের ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। স্থানীয়দের সহযোগিতায় এটি টিনে রূপান্তরিত হয়। এরপর তারা একটি তহবিল গঠন করেন। এরপর শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।
জনশ্রুতি রয়েছে, শঙ্কু নামে জনৈক হিন্দু মিস্ত্রি দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে থাকে। এতে ব্যয় হয় ৯ হাজার ৯৯৯ রুপিয়া ১০ আনা। ঐতিহাসিক এই মসজিদের স্থপতি হিসেবে মো. মখতুল এবং নবী বক্স নামে দুইজনের নামও শোনা গেছে।
মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়ালে চিনামাটির থালার ও কাঁচের ভগ্নাংশ বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘চিনি করা’ বা ‘চিনি দানার কাজ করা’। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই এর নামকরণ হয় চিনি মসজিদ। আবার কেউ কেউ বলেন পুরো মসজিদটিতে চীনা মাটির কাজ বলে একে চীনা মসজিদও বলা হতো। কালক্রমে চীনা মসজিদ থেকে এর নাম চিনি মসজিদ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মসজিদের পরিধি বাড়তে থাকে।
১৯২০ সালে হাজী হাফিজ আবদুল করিমের উদ্যোগে ৩৯ ফুট বাই ৪০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট মসজিদটির প্রথম অংশ পাকা করা হয়। হাজী আবদুল করিম নিজেই মসজিদটির নকশা এঁকেছিলেন। পুনরায় ১৯৬৫ সালে মসজিদের দক্ষিণ দিকে ২৫ বাই ৪০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট দ্বিতীয় অংশ পাকা করা হয়। সম্প্রতি এর আয়তন আরও বাড়ানো হয়েছে। ১৯৬৫ সালে বগুড়ার একটি গ্লাস ফ্যাক্টরি চিনি মসজিদের জন্য প্রায় ২৫ টনের মতো চীনা মাটির পাথর দান করে। এগুলো দিয়ে মোড়ানো হয় মসজিদের মিনারসহ বড় তিনটি গম্বুজ। এর মূল অংশের বর্ণ অনেকটা লালচে হলেও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পরবর্তী সময়ে তৈরি করা অংশ অনেকটা সাদা বর্ণের। এ ছাড়া সেই সময় কলকাতা থেকেও ২৪৩ খানা শংকর মর্মর পাথর এনে লাগানো হয় এই মসজিদে।
মসজিদের দেয়ালে অঙ্কিত ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, একটি বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদতারাসহ নানা চিত্র রয়েছে। এতে রয়েছে ২৭টি বড় মিনার, ৩২টি ছোট মিনার ও তিনটি বড় গম্বুজ। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদে রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ফটক। মসজিদের গোটা অবয়ব রঙিন চকচকে পাথরে মোড়ানো। আর বারান্দা বাঁধানো হয়েছে সাদা মোজাইকে। মসজিদের দোতলায় একটি ভবনসহ পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।