একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির প্রত্যাশা করছে সরকার। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বহুল আলোচিত এই মামলা উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যে পেপারবুক প্রস্তুতসহ শুনানির জন্য সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। শিগিগিরই হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণের নির্দেশনা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এ বিষয়ে গতকালও (বৃহস্পতিবার) অ্যাটর্নি জেনারেলের (এএম আমিন উদ্দিন) সঙ্গে কথা বলেছি। শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এখন বেঞ্চ নির্ধারণ ও তারিখ নির্ধারণে শিগগিরই ম্যানশন করা হবে।
কেমন সময়ের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার প্রত্যাশা করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আরো বলেন, কতদিনে শেষ হবে তা এখন বলা যাবে না। এটা জজ সাহেব করবেন। তবে যত দ্রুত সম্ভব এটা শেষ করা যায় সেই চেষ্টা আমাদের থাকবে।
২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার যে কয়টি চেষ্টা করা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলা। অল্পের জন্য হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী।
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলার ছক করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তার ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার মামলা দুটির কার্যক্রমে গতি আসছে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর মামলা দুটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ফলে এই মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২ জন। তাদের মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে দায়ের করা দুটি মামলায় রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে। বাকী ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। আসামীদের মধ্যে ৩১ জন কারাগারে আছেন। আর তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন।
২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। তারপর তা হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পরবর্তিতে গ্রেনেড হামলার মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির জন্য সরকারি ছাপাখানায় ( বিজি প্রেস) পাঠানো হয়। পরে পেপারবুক তৈরি পর বিজি প্রেস থেকে গত বছর ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে আসে।
দুই মামলায় সাড়ে ২০ হাজার পৃষ্ঠার ১ হাজার ৮০টি পেপারবুক তৈরি করা হয়েছে বলে জানায় সুপ্রিম কোর্ট। এরমধ্যে হত্যা মামলায় ১৩টি ভলিউমে মোট ৫৮৫টি পেপারবুক। এটি প্রায় সাড়ে দশ হাজার পৃষ্ঠার, এর মধ্যে আপিল ২২টি ও জেল আপিল ১২টি। অন্যদিকে বিস্ম্ফোরক মামলায় ১১টি ভলিউমে মোট ৪৯৫টি পেপারবুকের পরিসর দশ হাজার পৃষ্ঠা। এতে আপিল ১৭টি ও জেল আপিল ১২টি।
বর্তমানে মামলার মূল নথি ও পেপারবুক যাচাই-বাছাইয়ের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটি শেষ হলে আগামী মাসে হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণের নির্দেশনা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট্ররা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রধান বিচারপতি বরাবরে উপস্থাপন করা হবে।
পালাতক আসামীদের ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে:
গ্রেনেড হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ১৮ জন আসামী পলাতক রয়েছেন। এদের মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে রয়েছেন। তবে বাকী আসামীরা কোথায় আছেন সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই সরকারের কাছে।
যদিও সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানসহ পালাতক আসামীদের ফেরাতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। পালাতক আসামীরা কে কোথায় অবস্থান করছে তা চিহিৃত করার প্রক্রিয়া চালানো চলছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ বিষয়ে বলেন, শুধু তারেক রহমানই নয়, গ্রেনেড হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সব পলাতক আসামীদের দন্ড কার্যকরে ফিরিয়ে আনা চেষ্টা করছি।