চলতি অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারও বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ যোগান রাখা হয়েছে। মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এসময় নির্বাহী পরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমানসহ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিতি ছিলেন।
মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাঙ্খিত গতি সঞ্চারের উদ্দেশ্য বর্তমানে একটি সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থবছরের সামনের দিনগুলোতে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতিসহ বিশ্ব অর্থনীতি ও আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির উপর নির্ভর করে মুদ্রানীতি ও এর হাতিয়ার সমূহের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষভাবে সদা প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে ইতোমধ্যে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য উৎপাদনশীল খাতসমূহের পরিবর্তে অনাকাঙ্খিতভাবে অনুৎপাদনশীল খাতসমূহে ব্যবহৃত হয়ে সার্বিক মূল্য পরিস্থিতি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় যাতে কোনরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সদা সতর্ক রয়েছে। বার্ষিক ভিত্তিতে মুদ্রানীতি সম্বলিত ‘মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট’ প্রকাশিত হলেও দৈনিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখে প্রয়োজনে ‘ওপেন মার্কেট ওপারেশন’ পরিচালনার পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থবছরের যে কোন সময়ই মুদ্রানীতির নীতিগত দিক পরিবর্তন বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই বিবেচিত।
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণের উপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. করোনার প্রভাব মোকাবেলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইতোমধ্যে গৃহীত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি জোরদারকরণ
২. অর্থনীতির অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাতসমূহ যেমন- কৃষি, সিএমএসএমই, বৃহৎ শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ইতোমধ্যে গৃহীত পুনঃঅর্থায়ন স্কীম বর্ধিতকরণের পাশাপাশি করোনার কারণে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্থ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহ যেমন- ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক, হোটেল ও রেস্টুরেন্টের কর্মচারী এবং বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষাখাতের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের জন্য বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন স্কীম চালুকরণ
৩. নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গঠিত ৫০০ কোটি টাকার এবং তফসিলি ব্যাংকসমূহের পরিচালন মুনাফার ১ শতাংশ নিয়ে গঠিত স্টার্ট আপ ফান্ডের আকার পর্যায়ক্রমে বর্ধিতকরণ
৪. সিএমএসএমই খাতসমূহ, বিশেষ করে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্লাস্টার এন্ড ভ্যালু চেইন এবং নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে ব্যাংকের অর্থায়ন বৃদ্ধিকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কীম কার্যকরভাবে চালুকরণ
৫. অর্থনীতিতে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাংকগুলোর নূন্যতম সংখ্যক নিজস্ব জনবল দ্বারা প্রযুক্তি নির্ভর উপ-শাখা খোলার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ।
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়টি আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সরজমিনে নিরীক্ষা কার্যক্রম অনেকটা শিথিল থাকায় প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের কিছু অপব্যবহারের বিষয়ে ইতোমধ্যে দেশের গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, বর্তমানে করোনার দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরজমিনে পরিদর্শন/নিরীক্ষা কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও প্রযুক্তিনির্ভর অফ-সাইট নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের টাকা যে উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়েছে তা যেন অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যাংকসমূহের নিজস্ব নজরদারি বাড়িয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইতোমধ্যেই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতির কাঙ্খিত উন্নতির সাথে সাথেই প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে সরেজমিনে নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদারকরণের পাশাপাশি এর ব্যবহার ও ফলাফল বিষয়ে বিশেষ সমীক্ষা পরিচালনার বিষয়টিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় বিবেচনা রয়েছে। এছাড়া, আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং বিদেশে অর্থ পাচার রোধকল্পে বিএফআইইউ কর্তৃক আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।
গভর্নর আরো বলেন, করোনা মহামারিজনিত কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি প্রত্যাশিত মাত্রায় উজ্জীবিত না হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তারল্য বা তরল সম্পদ গড়ে উঠলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখনো অর্থনীতিতে অনেকটা অনিশ্চয়তাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে সিআরআর হ্রাসসহ মুদ্রানীতিতে ইতোপূর্বে যেসব শিথিলতা আনয়ন করা হয়েছিল তা পর্যায়ক্রমে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার সময় এখনো আসেনি বলে আমাদের বিবেচনায় প্রতিভাত হয়েছে। এছাড়া, মুদ্রানীতি প্রণয়নের পূর্বে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির প্রবীণ কর্ণধার, বিশেষজ্ঞ মহল, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, প্রাক্তন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালক পর্ষদের সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজন এর নিকট থেকে যেসকল মতামত পেয়েছি সেখানেও মুদ্রানীতিতে ইতোমধ্যে প্রদত্ত শিথিলতা পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এখনই তা করা সমীচীন হবে না বলেই সার্বিকভাবে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।