চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশ কী যুক্ত হতে যাচ্ছে? এক্ষেত্রে চীনের লক্ষ্য বাংলাদেশকে সাথে রাখা। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এ উদ্যোগে ঢাকাকে পাশে পেতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে দেশটি। আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরে জিডিআই সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার প্রস্তুতি ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি সই না হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সরকারপ্রধানের বেইজিং সফরে বেশ কিছু সমঝাতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে উভয়পক্ষ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-জিডিআই, রাজনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বাণিজ্য সহায়তা, টাকা-ইউয়ানে লেনদেন, ব্লু-ইকোনোমি, বিনিয়োগ সুরক্ষা, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সমীক্ষা, ডিজিটাল অর্থনীতি, একাধিক মৈত্রী সেতু নির্মাণ ও সংস্কার, মানুষে মানুষে যোগাযোগ এবং চীনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভির মধ্যে সহেযাগিতা।
এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি স্টেশনের বন্যা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিনিময় সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক নবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে।
২০২২ সালের আগস্টে ঢাকা সফর করেছিলেন চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই (তিনি বর্তমানে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী)। সেই সফরে চীনের প্রেসিডেন্টের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)-এর মতো উদ্যোগে বাংলাদেশকে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, জিডিআইয়ে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক।
লি’র উত্তরসূরি চীনের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত মার্চের মাঝামাঝিতে এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, জিডিআইয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
গত বছরে মে মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ-চীনের পররাষ্ট্র-সচিব পর্যায়ের সভায় দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সচিব) সুন ওয়েডং জিডিআই প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং বাংলাদেশকে যুক্ত হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বেইজিং বিভিন্ন সময়ে ডিজিআইয়ে ঢাকাকে যুক্ত করতে বিভিন্ন পরিকল্পনায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করেছে দেশটি।
সর্বশেষ, চলতি বছরের জুনের শুরুর দিকে বেইজিংয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র-সচিব পর্যায়ের সভায় ডিজিআই করার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছে দেশটি।
জিডিআই নিয়ে চীনের দিক থেকে অব্যাহত চেষ্টা এবং বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। সরকারপ্রধানের সফরে এই সংক্রান্ত দলিল সইয়ের প্রস্তুতির পরও কেন পেছনে সরে আসা? না কি কোনো কারণে অন্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বিরক্ত হতে পারে সেজন্য গোপনে এই দলিল সইয়ের কোনো পরিকল্পনা চলছে, এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট দুই কূটনীতিকের কাছ থেকে কোনো উত্তর মেলেনি। তবে অন্য এক কূটনীতিক বলেন, এটা এখন হবে না। এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না।
চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মুন্সি ফয়েজ আহমেদ। তিনি বলেন, জিডিআই নিয়ে বাংলাদেশ একটু ধীরে চলো নীতিতে চলছে। হয়ত আমরা চট করে যেতে চাই না। আমরা ইন্দো-প্যাসিফিকে এখনও যুক্ত হইনি। কিন্তু চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্ত আছি, এটা তো জিডিআইয়ের বাইরে না। ডিজিআইয়ে হয়ত আমরা এমনি যুক্ত থাকব, কিন্তু কোনো চুক্তি বা এমওইউ করব না। তবে এটা নিয়ে যে প্রধানমন্ত্রীর আলাপ-আলোচনা হবে না, সেটা বলা ঠিক হবে না। আলাপ-আলোচনা হবে। জিডিআইয়ে আমাদের যেতে বাধা দেখছি না। হয়ত চীনের গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) আমরা যাব না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী ৮ জুলাই সকালে ঢাকা থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী ৯ এপ্রিল তিনি বেইজিংয়ে বিজনেস ফোরামে যোগ দিয়ে বক্তব্য দেবেন। পরদিন বুধবার (১০ জুলাই) বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন।
বৈঠকে আর্থিক সহায়তা এবং নতুন প্রকল্পে অর্থায়নের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। পরে প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরের সময় দেশটির সঙ্গে বেশ কয়েকটি দলিল সইয়ের কথা রয়েছে। এছাড়া সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুর বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর চাইনিজ ভাষায় অনুবাদের মোড়ক উন্মোচন করবেন।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীকে বেইজিং নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল চীনের। গত বছরের (২০২৩) ২৩ সেপ্টেম্বর চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে অতিথি করতে চেয়েছিল চীন। তবে ওই সময়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবেন বলে সরকারপ্রধান চীনে যেতে পারবেন না বলে বেইজিংকে জানানো হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সর্বশেষ চীন সফর করেছিলেন। তখন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।
গত বছরের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক করেন হাসিনা-শি। ২০১৯ সালের পর দুই শীর্ষ নেতা ওই বৈঠকে বসেন।
পরে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চীন সফরে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে দেশটি। গত রমজানের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীকে চীন সফর করার একটা ‘তড়িঘড়ি’ প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকার পক্ষ থেকে বেইজিংকে জানানো হয়েছিল, সরকারপ্রধান রমজান মাসে বিদেশ সফর করেন না।
সবশেষ চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। রাষ্ট্রদূত বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে আগামী জুলাইয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করেছেন সরকারপ্রধান। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই বেইজিং সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী।