পারমাণবিক জ্বালানি বা ইউরেনিয়ামের মালিক হওয়ার মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎখাতে নব দিগন্তের সূচনা হলো। বিশ্বের মোট ১৯৩টি স্বাধীন দেশের মধ্যে পরমাণু সমৃদ্ধ দেশের সংখ্যা মাত্র ৩২টি। ৩৩তম দেশ হিসেবে চলতি বছর বাংলাদেশ এখন পরমাণু সমৃদ্ধ দেশের তালিকায়। ইউরেনিয়ামের মজুত যেখানে শক্তিমত্তা প্রমাণের হাতিয়ার, সেখানে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশ এখন ইউরেনিয়ামের মালিক।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল ৩টা ৫২ মিনিটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি।
গেল ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে পাওয়া ইউরেনিয়াম কড়া নিরাপত্তায় রূপপুরে নিয়ে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকালে পারমাণবিক জ্বালানির দ্বিতীয় চালান আসে দেশে। আজ বিকেলে রূপপুরের পারমাণবিক প্রকল্পের ইউরেনিয়াম বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করল রাশিয়া। এ উপলক্ষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আয়োজন করা হয় গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের। দুই দেশের সরকার প্রধানের অনুমতিতে সেখান পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। এটি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলো বাংলাদেশ।
কবে উৎপাদনে যাবে
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রর প্রথম ইউনিটের ভৌত এবং অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। রাশিয়া থেকে আমদানি করা ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়ামসহ পরমাণু চুল্লির বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে এপ্রিল পর্যন্ত। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য ইউনিট-১ প্রস্তুত হবে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই উৎপাদনে যাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এর দ্বিতীয় ইউনিটের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। ২০২৬ সালেই উৎপাদনে আসবে ২য় ইউনিট। সিডিউল অনুযায়ী শেষ হবে এর নির্মাণকাজ।
কত জ্বালানি প্রয়োজন
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট (১২০০ মেগাওয়াট) চালু করার জন্য ৭৫ টন ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হবে। একবার জ্বালানি দেওয়ার পর ১৮ মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এরপর এক-তৃতীয়াংশ ইউরেনিয়াম অর্থাৎ ২৫ টন নিউক্লিয়ার বর্জ্য তুলে নিয়ে সেখানে নতুন ইউরেনিয়াম রড দিতে হবে। এরপর চলবে আরও ১৮ মাস। এভাবে ১৮ মাস পরপর আংশিক জ্বালানি পরিবর্তন করতে হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুফল
আমাদের দেশের বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, তার অন্তত দশ ভাগ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পূরণ করতে সক্ষম হবে। এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এটি শুধু বিনিয়োগের দিক থেকে নয়, একই সঙ্গে উচ্চতর ও সংবেদনশীল সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে দেশের একমাত্র প্রকল্প।
কত খরচ হল
দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বৃহৎ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ব্যয় ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণসহায়তা হিসাবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দুটি ইউনিট চালু হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
রুপপুরের পিছনের ইতিহাস
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, সর্বপ্রথম ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে লক্ষ্যে ১৯৬২-৬৮ সাল অর্থাৎ এ ছয় বছরের মধ্যে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদীতীরবর্তী রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের যথার্থতা যাচাই করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউস, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণকাজ আংশিক শেষ করা হয়। সে সময় রূপপুরে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলেও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এ প্রকল্প বাতিল করে দেন। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রকল্পের অগ্রগতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৯৭৭-১৯৮৬ পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া রূপপুরে ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন, যার ভিত্তিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্লান-২০০০ অনুমোদন করে।
কিন্তু সরকার বদল হলে ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত রূপপুর প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ থাকে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম ছিল রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা। এ লক্ষ্যে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলি সম্পাদন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলি ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৩ মে ২০০৯ তারিখে বংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন (রোসাটোম)-এর মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
পরের বছর প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ৮টি সাবগ্রুপ গঠন করা হয়। ১০ নভেম্বর ২০১০ তারিখে জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো বাংলাদেশ সফর করেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে আইএইএ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো ২০১৭ সালের ৩ জুলাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি এ কেন্দ্র স্থাপনে সব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশনের সঙ্গে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট সহযোগিতা চুক্তি সই হয়। সেদিন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথে পা দেয় এবং দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবে পদার্পণ করে।
পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর এবং ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যথাক্রমে এই কেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লিপাত্র বা রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন। উভয় অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাবনার ঈশ্বরদীতে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।