ক্ষমতাসীন এনডিএ জোটের প্রার্থী আদিবাসী সাঁওতাল নারী দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার তিন দফায় ভোট গণনা শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। ৫০ শতাংশের বেশি ভোটমূল্য পেয়ে ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যশবন্ত সিনহা পরাজয় স্বীকার করেছেন। আগামী ২৫ জুলাই ভারতের ১৫তম নতুন রাষ্ট্রপতির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের মেয়াদ শেষ হবে ২৪ জুলাই।
তিন দফা গণনার পর দ্রৌপদী মুর্মু মোট ভোটমূল্যের ৫১ দশমিক ২ শতাংশ পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার বলছে, দ্রৌপদীর জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৫ লাখ ৪০ হাজার ৯৯৬ ভোটমূল্য। গণনায় দ্রৌপদী ভোটমূল্য পেয়েছেন ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৭।
এদিকে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি প্রধান জে পি নাড্ডাসহ মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্যরা দ্রৌপদী মুর্মুকে অভিনন্দন জানাতে তার বাসভবনে যাচ্ছেন।
এক টুইটে পরাজয় স্বীকার করে বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যশবন্ত সিনহা বলেছেন, আমি ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয় পাওয়ায় দ্রৌপদী মুর্মুকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি— প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি ভারতীয় আশা করে যে, ভারতের ১৫তম রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ভয়ডরহীন অথবা পক্ষপাত ছাড়াই সংবিধানের রক্ষক হিসেবে কাজ করবেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় দিল্লিতে পার্লামেন্ট ভবনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোট গণনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে প্রাথমিক আলোচনা শেষে দুপুর দেড়টায় শুরু হয় মূল গণনা। প্রথম দফার গণনায় মুর্মু ৩৯ শতাংশের ভোটমূল্য স্পষ্ট হয়ে যায়।
প্রথম কোনও আদিবাসী নারী রাইসিনা হিলের মসনদে যাওয়ায় দেশজুড়ে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা উল্লাস-উদযাপন শুরু করেছেন। দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতর থেকে রোড শোর মাধ্যমে মুর্মুর বিজয় উদযাপন শুরু হয়েছে। এছাড়াও বিজেপির অন্যান্য সব রাজ্য শাখাও বিজয় মিছিলের পরিকল্পনা করেছে।
দ্রৌপদী মুর্মু পেশায় শিক্ষক ছিলেন। ৬৪ বছর বয়সী ওড়িশার এই আদিবাসী নারী গত কয়েক দশক ধরে বিজেপির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ঝাড়খণ্ড প্রদেশের প্রাদেশিক গভর্নরও ছিলেন তিনি।
ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি কে এই দ্রৌপদী মুর্মু
ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া আদিবাসী সাঁওতাল নারী দ্রৌপদী মুর্মু। তিনিই দেশটির প্রথম কোনও আদিবাসী নারী, যিনি রাইসিনা হিলসের মসনদে বসলেন ৫০ শতাংশের বেশি ভোটমূল্য পেয়ে।
ভারতের নবনির্বাচিত আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন ২০১৭ সালে। ওই সময় ওড়িশার এই আদিবাসী নারীকে দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দ্রৌপদী মুর্মুর জন্ম ১৯৫৮ সালে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য তিনি। একজন গ্রাম পরিষদ প্রধানের কন্যা মুর্মু রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরের রামাদেবী মহিলা কলেজে পড়াশোনা করেন।
ওড়িশা সরকারের একজন কেরানি হিসাবে কর্মজীবন শুরু হয় মুর্মুর। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সেখানকার সেচ ও জ্বালানি বিভাগের জুনিয়র সহকারী হিসাবে কাজ করেন তিনি। শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে ভুবনেশ্বরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর পরিবারের দেখভালের জন্য রায়রাংপুরে ফিরে আসেন দ্রৌপদী। পরে শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন তিনি।
দ্রৌপদীর রাজনীতিতে পথচলা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। ওই বছর তিনি রায়রাংপুরের স্থানীয় নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাকে প্রায়ই ড্রেন পরিষ্কার থেকে শুরু করে আবর্জনা অপসারণের সময়ও রোদে দাঁড়িয়ে শহরের স্যানিটেশন কাজের তত্ত্বাবধান করতে দেখা যায়।
বিজেপির সদস্য হিসেবে তিনি রায়রাংপুর আসনে দু’বার বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন— ২০০০ এবং ২০০৯ সালে। ২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিজু জনতা দল পার্টির নবীন পট্টনায়কের নেতৃত্বে রাজ্যের জোট সরকারের মন্ত্রী হন। প্রাথমিকভাবে বাণিজ্য ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দফতর সামলান তিনি। পরে রাজ্যের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীও হন তিনি।
২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ‘তফসিলি উপজাতির’ বিজেপির রাজ্য শাখার সভাপতি ছিলেন মুর্মু। ভারতের সংবিধানে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায় হিসেবে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর স্বীকৃতি রয়েছে। ২০০৯ সালে দুঃখজনক মোড় নেয় দ্রৌপদীর জীবন; রহস্যজনক এক পরিস্থিতিতে বড় ছেলেকে হারিয়ে ফেলেন তিনি। এর কয়েক বছর পর দ্বিতীয় ছেলে এবং স্বামীকেও হারান তিনি।
নিজেকে সামলে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেন মুর্মু। ২০১৫ সালে প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের প্রথম নারী গভর্নর নিযুক্ত হন তিনি। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ছয় বছর এই পদে আসীন ছিলেন তিনি।