১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার যে বোঝাপড়া ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র শাসিত বিশ্বব্যবস্থা কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয় বিশ্বের বৃহত্তম এই দেশটি। এ কারণে এখন থেকে বিশ্বের পূর্বাঞ্চলীয় বা প্রাচ্য দেশগুলোর সঙ্গে মিত্রতায় গুরুত্ব দেবে রাশিয়া, ভরসাও রাখবে তাদেরই ওপর।
শুক্রবার রুশ সংবাদ মাধ্যম আরটি ইংলিশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সের্গেই ল্যাভরভ, যিনি ২০০৪ সাল থেকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন।
আরটি ইংলিশকে ল্যাভরভ বলেন, ‘এটা সত্যি যে, ১৯৯১ সালের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের বোঝাপড়া ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল; কিন্তু আমাদের পশ্চিমা অংশীদাররা যদি মনে করে— এখনও আমরা তাদের ভরসা করি, সেক্ষেত্রে তারা বিভ্রান্তিতে আছে এবং এই বিভ্রান্তি স্থায়ী হবে না।’
‘আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গে আমি বলব— এই দেশ আসলে বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে দেখতে চায় না, তারা চায় একটি অ্যামেরিকান ভিলেজ; অর্থাৎ এমন একটি বিশ্ব যেখানে কেবল তাদেরই আধিপত্য চলবে।’
‘তাদের কল্পিত অ্যামেরিকান ভিলেজের অবস্থা অনেকটা সেসব পানশালার মতো, যেখানে শক্তিমানরা বন্দুকের জোরে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখে। চীন, ভারত, ব্রাজিলের মতো বিশ্বের অনেক দেশই আর আঙ্কল স্যামের (যুক্তরাষ্ট্র) তাদের আধিপত্য মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।’
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর শীতলযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক চরম তিক্ততায় পৌঁছায়। দীর্ঘ প্রায় ৫ দশক এই যুদ্ধ চলার পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটে তার।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যে দ্বন্দ্ব, সেটিও মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোকে ঘিরেই। ২০০৮ সালে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করার পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে সংকট তৈরি হয়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই নির্দেশের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে পুতিন বলেছেন, ‘রাশিয়াকে হুমকি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেইনকে ব্যবহার করার চেষ্টা প্রতিহত করা এবং দোনেতস্ক ও লুহানস্কের রুশভাষীদেরকে ইউক্রেইনের ‘গণহত্যার’ হাত থেকে বাঁচাতে এই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এদিকে সামরিক অভিযানের শুরু থেকেই রাশিয়ার ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন। ইতোমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রুশ ব্যাংকগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকেও রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ক্যাস্টেলাম ডট এআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে শীর্ষে আছে রাশিয়া। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে গত দু’সপ্তাহে দেশটির বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭৭৮টি নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
অতীতেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর জারিকৃত নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলোসহ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মোট নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা এখন ৫ হাজার ৫৩০।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার ভূমিকা কেমন হবে— প্রশ্নের জবাবে ল্যাভরভ বলেন, ‘আমরা প্রাাচ্যকে গুরুত্ব দেবো। আমরা এখন ভরসা রাখব নিজেদের ওপর এবং সেইসব মিত্রদের ওপর, যারা এখনও আমাদের সমর্থন করে।’
‘তবে আমরা পশ্চিমাদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি না, যেমনটা তারা আমাদের সঙ্গে করেছে।’
সূত্র: রয়টার্স