<< মূল্যস্ফীতি কমাতে বাড়ছে সুদহার

ডিসেম্বরে মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াবে।  নীতি সুদহার এখন ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ আছে। ফলে নতুন নীতি সুদহার বা রেপো রেট হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

বুধবার (৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। রেপো রেট বৃদ্ধি করায় ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে।

নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদহারও বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল।

নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ট্রেজারি বন্ড বিলের সুদ বাড়ায় স্মার্ট রেট বৃদ্ধি পাবে। আর ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হিসাবে স্মার্ট সুদের হার নির্ধারণ করায় এখন থেকে আমানত ও ঋণের সুদহারও বাড়বে।

রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বর্তমানে সার্বিক মূল্যস্ফীতির ধারা সহনীয় পর্যায়ে রাখা এবং প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে আজ অনুষ্ঠিত মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) ৬০তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক (ক) বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার তথা ওভারনাইট রেপো সুদহার বিদ্যমান বার্ষিক শতকরা ৬.৫০ ভাগ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে শতকরা ৭.২৫ ভাগ; (খ) স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (ফ্লোর) সুদহার বিদ্যমান বার্ষিক শতকরা ৪.৫০ ভাগ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে শতকরা ৫.২৫ ভাগ; (গ) স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (সিলিং) সুদহার বিদ্যমান বার্ষিক শতকরা ৮.৫০ ভাগ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে শতকরা ৯.২৫ ভাগে পুনঃনির্ধারণ করা হলো। যা আগামীকাল (৫ অক্টোবর) থেকে কার্যকর হবে।

যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, তা হলো ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা– সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট রেট) ছিল ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে হয় ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। সবশেষ সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসের ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে অক্টোবর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। অন্যদিকে ৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করতে পারে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

সেই হিসেবে, চলতি অক্টোবর মাসে ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। অন্যদিকে, সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করে ঋণের বিপরীতে সুদ নিতে পারবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এনবিএফআই। তাদের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১২ দশমিক ২০ শতাংশ এবং আমানতে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে অক্টোবরে ঠিক করা ঋণের এই সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। তাই অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেসব পরামর্শ আসবে সে অনুযায়ী আগামী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হবে। এরই অংশ হিসেবে অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে নীতি পর্যালোচনা সভা হয়। সভায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির আরও সংকোচনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। তিনি এই মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি  স্থিতিশীলতা বড় বিষয় বলে উল্লেখ করেন। এসময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিনিয়র সচিব এবং ডেপুটি গভর্নররা সভায় উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে মূল্যস্ফীতি চাপ, ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা এবং লাগামহীন খেলাপি ঋণ এখন অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তর মতে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলে এমনিতেই ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক বৈঠকে এসব পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।

গত ২১ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এর সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বৈঠকে নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।